কালের কলস

72
0

অনিচ্ছায় কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপায়ী তৃষ্ণার লোচন
ক্লান্ত হয়ে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায় বহুদূর অতল আঁধারে
আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন
আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো
কতকাল কতযুগ ধরে
দেখবো, দেখার ভারে বৃষের স্কন্ধের মতো নুয়ে আসে রাত্রির আকাশ ?
কে ধারালো বর্শা হেনে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই কৃষ্ণকায়
ষাঁড়ের শরীরে
আর সে আঘাত থেকে কী-যে ঝরে পড়ে ঠিক এখনো বুঝি না
একি রক্ত, মেদ, অগ্নি কিম্বা শ্বেত আলো ঝরে যায়
অবিরাম অহোরাত্র প্রাণ আর কিমাকার ভূগোলে কেবলই–
ঝরে যায় ঝরে যেতে থাকে ।

ক্রমে তাও শেষ হলে সে বন্য বৃষভ যেন গলে যায় নিসর্গশোভায় ।
তুমি কি সোনার কুম্ভ ঠেলে দিয়ে দৃশ্যের আড়ালে দাঁড়াও
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন ?
আকাশে উবুড় হয়ে ভেসে যেতে থাকে এক আলোর কলস
অথচ দেখে না কেউ, ভাবে না কনককুম্ভ পানকরে কালের জঠর ;
ভাবে না, কারণ তারা প্রতিটি প্রভাতে দেখে ভেসে ওঠে আরেক আধার
ছলকায়, ভেসে যায়, অবিশ্রাম ভেসে যেতে থাকে ।

কেমন নিবদ্ধ হয়ে থাকে তারা মৃত্তিকা, সন্তান আর শস্যের ওপরে
পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভয়ার্ত যুবতী
ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায় অনির্বাণ জন্মের আঘাত ।
মাংসের খোড়ল থেকে একে একে উড়ে আসে আত্মার চড়ুই
সমস্ত ভূগোল দ্যাখো কী বিপন্ন শব্দে ভরে যায়
ভরে যায়, পূর্ণ হতে থাকে।

এ বিষণ্ণ বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ ।

আল মাহমুদ
লিখেছেন

আল মাহমুদ

আল মাহমুদ ছিলেন একজন বাংলাদেশী কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি একাধারে ছিলেন একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মসজিদবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মীর আবদুল হাই এবং মাতার নাম মরিয়ম খাতুন।

তিনি ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "লোক লোকান্তর" প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "কালের কলস" (১৯৬৬), "সোনালী কাবিন" (১৯৭৩), "মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো" (১৯৭৮), "নিরালা ঘাটের ঐ বিদায়" (১৯৮৪), "কবর থেকে উঠে আসা" (১৯৯০), "আবার শরৎ এলো" (১৯৯৭), "সোনালি কাবিনের উপকথা" (২০০২)।

আল মাহমুদ তার কাব্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তার কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, দুঃখ, ক্ষোভ, আশা, স্বপ্ন ইত্যাদি নানামুখী অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন।

তিনি একজন প্রগতিশীল কবি। তার কবিতায় তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচার, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর উচ্চারণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আল মাহমুদ তার কবিতা ও সাহিত্যকর্মের জন্য বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে:

* একুশে পদক (১৯৮৬)
* বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮)
* মরহুম মওলানা আবুল কালাম আজাদ পুরস্কার (১৯৭৪)
* হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২)
* নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮৮)
* স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৩)

আল মাহমুদ ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। তার কবিতা ও সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অমূল্য অবদান রেখেছে।

মন্তব্য করুন