পরবাসী

3
0

যাহাদের পায়ে পায়ে চলে চলে জাগিয়াছে আঁকাবাঁকা চেনা পথগুলি
দিকে দিকে পড়ে আছে যাহাদের দেহমাটি—করোটির ধূলি,
যাহারা ভেনেছে ধান গান গেয়ে—খুঁটেছে পাখির মতো মিঠে খুদকুঁড়া,
যাহাদের কামনায় ইশারায় মাটি হল পানপাত্র, শষ্প হল সুরা!
ছুঁয়ে ছেনে বারবার এ ভাঁড়ার করে গেছে স্যাঁতসেঁতে ম্লান,
আনাচে-কানাচে আজও দুলিতেছে যাহাদের উড়ানি-পিরান,
যাদের দেহের ছায়া পাঁচিলের গায় গায় মেখে গেছে মায়া,
দেয়ালের শেওলায় নীল হয়ে জেগে আছে যাহাদের কায়া,
যারা গেছে বীজ বুনে মাঠে মাঠে,—চষে গেছে মাটি,
কেটেছে ফসল, শালি বেঁধে-বেঁধে নেছে আঁটি আঁটি,
তুলিয়াছে গোলাবাড়ি—যত তিষি, ধান খড় ভরা,
পেঁচা-ইঁদুরের সনে আন্‌মনে জাগিয়াছে যাদের প্রহরা,
পনির ননীর গন্ধে ভরিয়াছে যাহাদের তুষ্ট গৃহস্থালি,
ধুনুচিতে ধূপ ঢেলে—উঠানে প্ৰদীপ জ্বালি জ্বালি
চরকায় সুতো কেটে তুলিয়াছে তন্ময় গুঞ্জন,
কহিয়াছে আধো আধো কত কথা—নিভায়েছে–জুলায়েছে আলো,
দেয়ালে তাদের ছায়া জাগিয়াছে এলোমেলো—কালো—
না জানি কোথায় তারা, কত দূরে—জানি না তো কিছু!
রাতভোর ঘোর ঘোর চোখ মোর, ঘাড়খানা নিচু
তাদের সন্ধানে যেন–যাহাদের রেণুঝরা হিম মরা প্রজাপতি ডানা
দিকে দিকে পড়ে আছে—মনে হয়। কত চেনা–কত তারা জানা!
তাহাদেরই পরীপাখা ওড়ে যেন পাউষের নদীটির বুকে!
শিশিরনিবিড় মাঠ-পাথরের মুখে
তারা যেন কথা কয়!—শাঁইঝাড়ে—শালুকের দলে
জোনাকির পাখনার তলে যেন তাঁহাদের দীপ আজও জ্বলে!
সঙ্গোপনে বনে বনে ফেরে তারা—জ্যোৎস্নারাতে পিয়ালের মৌ
আজও তারা পান করে, আজও তারা গান করে—বাসরের বর আর বউ!
শিশিরের জলে জলে স্নান করে–ভিজে ভিজে বালুচর দিয়া
বুনো হাঁস-হাঁসীদের সনে ফেরে পরবাসী প্রিয় আর প্রিয়া!
কোরা-ডাহুকের বুকে কান পেতে শুনে যায় গান—
তাদের আঙুল ছুঁয়ে চুলবুল করে ওঠে হেমন্তের মাঠভরা ধান!
তাদের দেখেছি আমি গেঁয়ো পথে–দেখেছে রে ধাঙড়ের বধূ,
মৌচুষ্‌কির সনে তারা বনে লুটে খায় কমলার মধু!
নোনার পাতায় তারা মাথা পেতে খায় তাতা ক্ষীর!
নোনার পাতায় তারা মাথা পেতে খায় তাতা ক্ষীর!
বেদের মতন তারা আসে যায়–অবেলায় ভেঙে ফেলে ভিড়!
তাদের দেখেছি আমি শাদা ভোরে—ঘুঘু ডাকা উদাস দুপুরে!
—সাঁঝের নদীর বাটে—ভাঙা হাট–ভিজা মোঠ জুড়ে;
পাড়াগাঁর পথে পথে নিঝ্‌ঝুম চাঁদিনীর রাতে
ফিরেছে রে, ভিড়েছে রে কত বার তারা মোর সাথে!

জীবনানন্দ দাশ
WRITTEN BY

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন